সূফী-সাধকদের সাথে সম্পর্কিত যে জেলাগুলোর নাম

বাংলাদেশের ৮টি বিভাগে ভাগ করে সর্বমোট ৬৪টি জেলা রয়েছে। আর এই ৬৪ জেলার প্রত্যেকটি জেলার নামকরণে রয়েছে স্বতন্ত্র ইতিহাস। কোন জেলা কি কারণে নামকরণ করা হয়েছে তা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। তাদের মধ্য থেকে যেসব জেলাগুলো প্রাচীন বাংলার সুফী সাধক কিংবা ধর্মসংস্কারকদের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে তাদেরকে নিয়েই আজকের আয়োজন।

মেহেরপুর

মেহেরপুর জেলার নামকরণ সম্পর্কে নানা তথ্য শোনা গেলেও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতটি হচ্ছে, তৎকালীন ইসলাম প্রচারক দরবেশ মেহের আলী নামীয় জনৈক ব্যক্তির নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মেহেরপুর রাখা হয়। মেহের আলী ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে ইয়ামন শহরের খ্যাতিময় কোনিয়া বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কোরআনে হাফেজ, শরিয়ত, হাকিকত, হাদিস ও তাছাউফ, তফসীর ও ফিকহ শাস্ত্রে ব্যাপক জ্ঞান লাভ করেন। এরপর তিনি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারত উপমহাদেশে আসেন। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ১৬৫৯ সালের দিকে তিনি মেহেরপুরে উপস্থিত হন। এখানে এসে তিনি একটি দরবারও প্রতিষ্ঠা করেন।

চাঁদপুর

চাঁদপুর জেলাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্রগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। কথিত আছে চাঁদপুরের (কোড়ালিয়া) পুরিন্দপুর মহল্লার চাঁদ ফকিরের নামানুসারে এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয় চাঁদপুর। কারো কারো মতে, শাহ আহমেদ চাঁদ নামে একজন প্রশাসক দিল্লী থেকে পঞ্চদশ শতকে এখানে এসে একটি নদী বন্দর স্থাপন করেছিলেন। তাঁর নামানুসারে চাঁদপুর। ১৮৭৮ সালে প্রথম চাঁদপুর মহকুমার সৃষ্টি হয়। ১৮৯৬ সালের ১ অক্টোবর চাঁদপুর শহরকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

 জামালপুর

সাধক দরবেশ হযরত শাহ জামাল (রহ.) এর স্মৃতি বিজড়িত অপার সৌন্দর্যঘেরা গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জেলাটির নাম জামালপুর। শোনা যায়, বৃহত্তর ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত যমুনা-ব্রক্ষ্মপুত্র বিধৌত এই জেলাটি হযরত শাহ জামাল (রহ.) এর নামানুসারে নামকরণ হয়।

বাগেরহাট

বাগেরহাটের প্রাচীন নাম ছিল খলিফাতাবাদ বা প্রতিনিধির শহর। প্রখ্যাত সূফী ও মুসলিম ধর্ম প্রচারক খানজাহান আলী (রহ.) গৌড়ের সুলতানদের প্রতিনিধি হিসেবে এ অঞ্চল শাসন করতেন। তবে কেউ কেউ মনে করেন, বরিশালের শাসক আঘা বাকের এর নামানুসারে বাগেরহাট হয়েছে। কেউ বা বলেন, পাঠান জায়গীদার বাকির খাঁ এর নামানুসারে বাগেরহাট হয়েছে। তবে ধর্মপ্রচারক খানজাহান আলী (রহ.) এর একটি বাগ (বাগান, ফার্সী শব্দ) বা বাগিচা থাকায় এই বাগিচা শব্দটি হতে বাগেরহাট নামে উৎপত্তি হয়েছে, এই ধারণাটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পায়।

ফরিদপুর

ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ফরিদপুর জেলাটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৮৬ সালে, মতান্তরে ১৮১৫ সালে। ফরিদপুরের নামকরণ করা হয়েছে এখানকার প্রখ্যাত সুফি সাধক শাহ শেখ ফরিদুদ্দিনের নামানুসারে। এ জেলার পূর্বনাম ছিল ‘ফতেহাবাদ’। ফরিদপুর জেলার প্রতিষ্ঠা সন ১৭৮৬ হলেও তখন এটির নাম ছিল জালালপুর। জানা যায় তখন জেলাটির প্রধান কার্যালয় ছিলো ঢাকা।

ময়মনসিংহ

ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান ছিলেন সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। তিনি তিরমিজের বাসিন্দা মক্কার শরিফ সাইদ আশরাফুল হোসাইনি আল ফাতিমি আল মাক্কির পুত্র ছিলেন। সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই থেকে নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি। তার আগে আইন-ই-আকবরীতে ‘মিহমানশাহী’ এবং ‘মনমনিসিংহ’ সকার বাজুহার পরগনা হিসেবে লিখিত আছে। পরবর্তীতে সেটাই ময়মনসিংহ নামে পরিচিতি লাভ করে।


মাদারীপুর

বৃহত্তর ঢাকা বিভাগের মাদারীপুর জেলাটি বহু আগ থেকেই ঐতিহাসিক ভাবে সমৃদ্ধ একটি জনপদ ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর পীর আউলিয়াদের মধ্যে হযরত বদরুদ্দিন শাহ মাদার (রহ.) এর বেশ নামধাম ছিলো। তাই তারই নামানুসারে এই জেলার নামকরণ করা হয়। মাদারীপুরের প্রাচীন নাম ছিল ইদিলপুর। ১৯৮৪ সালে মাদারীপুর জেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

মুন্সিগঞ্জ

মুন্সিগঞ্জে প্রাচীন নাম ছিল বিক্রমপুর বা ইদ্রাকপুর। মোঘল শাসনামলে এই ইদ্রাকপুর গ্রামে মুন্সি হায়দার হোসেন নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মুঘল শাসকদের নিয়োগতকৃত বিক্রমপুরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। অত্যন্ত সজ্জন, জনহিতৈষী ও সাধক প্রকৃতির মুন্সি হায়দার হোসেনের নামে ইদ্রাকপুরের নাম পরিবর্তন করে মুন্সিগঞ্জ রাখা হয়। কারো কারো মতে জমিদার এনায়েত আলী মুন্সি নামানুসারে মুন্সিগঞ্জে নামকরণ করা হয়।

মৌলভীবাজার

সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা (রহ.) এর ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত ইয়াছিন (রহ.) এর উত্তর পুরুষ মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ “মনু” নদীর তীরে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠার পরপরই নৌ ও স্থলপথে বাজারটিতে ক্রমশ লোকসমাগম বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীতে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাজারটিকে কেন্দ্র করে ২৬টি পরগনা নিয়ে দক্ষিণ শ্রীহট্টমহকুমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই দক্ষিণ শ্রীহট্ট বা সাউথ সিলেটের পরিবর্তন করে মহকুমাটির নাম মৌলভীবাজার রাখা হয়। ১৯৮৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার মহকুমাটি জেলায় উন্নীত হয়।

শরীয়তপুর

নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংঘটিত ফরায়েজী আন্দোলনের পথিকৃৎ হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন সে সময়ের অন্যতম ধর্ম সংস্কারক। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মক্কা গমনের পর ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে বাংলায় ফিরে এসে ধর্ম সংস্কার শুরু করেন এবং মুসলিম ধর্মের উৎপীড়নমূলক নিয়ম রদ করে ভন্ড মোল্লা মৌলবীদের হাত থেকে তাঁর শিষ্যদের রক্ষায় ব্রতী হন। আর তারই নামানুসারে ঢাকা জেলার অন্তর্গত শরীয়তপুর জেলাটির নামকরণ করা হয়।

হবিগঞ্জ

সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) এর অনুসারী সৈয়দ নাসিরুদ্দীন (রহ.) এর স্মৃতি বিজড়িত কারাঙ্গী, বিজনা, রত্না প্রভৃতি নদী বিধৌত যে অঞ্চলটি বর্তমান সিলেট জেলায় হবিগঞ্জ নামে পরিচিত। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ হবিগঞ্জ জেলায় উন্নীত হয় ঐতিহাসিক এই প্রাচীন জনপদ। তৎকালীন সুলতানসী হাবেলীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ সুলতানের অধঃস্থন পুরুষ সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহর পুত্র সৈয়দ হাবীব উল্লাহ খোয়াই নদীর তীরে বর্তমান হবিগঞ্জ খ্যাত গঞ্জটি প্রতিষ্ঠা করেন।