ভাষা আন্দোলনে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তাদের অনেকেরই লাশ গুম করে ফেলার কারনে খুঁজে পাওয়া যায় নি। যাদের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিলো তাদের মধ্যে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার এর নামই বেশী শোনা বা পাঠ করা যায়। বাংলা একাডেমী ও ভাষা-আন্দোলন মিউজিয়াম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ছয় শহীদের তথ্য এখানে যুক্ত একত্রিত করলাম। এই ছয় জনকে নিয়ে ছয়টি পোস্ট দিয়েছিলাম সামুতে ২০১১ সালে। কিন্তু কোন নোটিশ ছাড়াই সামু আমার একাউন্ট বন্ধ করায় সেগুলো হারিয়ে গেছে।
শহীদ আব্দুস সালাম
শহীদ আব্দুস সালাম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন। গ্রাম- লক্ষনপুর, উপজেলা-দাগনভূঁইয়া, জেলা- ফেনী। পিতার নাম- মোঃ ফাজিল মিয়া, মাতার নাম- দৌলতুন্নেসা। ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে আব্দুস সালাম ছিলেন সবার বড়। তিনি দাগন ভুঁইয়ার করিমউল্লাহপুর হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর কামাল আতাতুর্ক বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হলেও পারিবারিক কারণে আর লেখাপড়া করতে পারেন নি। অতঃপর চাচাতো ভাই আবদুল হালিমের সহায়তায় ঢাকা চলে আসেন। ৮৫ দিলকুশাস্থ “ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রুজ” এ করনিক পদে চাকুরী নেন। শহীদ আব্দুস সালাম ২১শে ফেব্রুয়ারীর বিক্ষোভে অংশগ্রহন করে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে গুলীবিদ্ধ হন। তখন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেড়মাস পরে ৭ এপ্রিল সকাল ১১টায় তিনি মারা যান।
শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ
শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ এর জন্ম ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর। গ্রামের নাম-পারিল (বতর্মানে যার নামকরন করা হয়েছে রফিকনগর), থানা- সিংগাইর, জেলা- মানিকগঞ্জ। তার পিতার নাম- আব্দুল লতিফ, মাতার নাম- রাফিজা খাতুন। ৫ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে রফিক উদ্দিন আহমদ ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার বড়। তিনি মানিকগঞ্জ বায়রা কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্রনাথ কলেজে আই কম পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। কলেজের পাঠ ত্যাগ করে ঢাকায় এসে পিতার সঙ্গে প্রেস পরিচালনায় যোগ দেন। ২১শে ফেব্রুয়ারীতে শাসকগোষ্ঠীর জারীকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে বিক্ষোভ মিছিল হয় সেখানে তিনি অংশগ্রহন করেন।পুলিশের বেদম লাঠিচার্জ ও কাদানে গ্যাসের কারনে অন্যান্যদের সাথে তিনিও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে আশ্রয়গ্রহন করতে যান। এ সময়ে পুলিশের একটু গুলী সরাসরি তার মাথায় আঘাত হানে ও তিনি সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সম্ভবত ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রথম শহীদ হওয়ার মর্যাদা রফিক উদ্দিন আহমদই লাভ করেন। তাকে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়। তবে দুঃখজনকভাবে পরবর্তীতে তার কবর চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি।
শহীদ আবুল বরকত
শহীদ আবুল বরকত ১৯২৭ সালের ১৬ জুন ভারতীয় উপমহাদেশের (অবিভক্ত) মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ছিলেন মৌলবী শামসুদ্দীন সাহেবের জ্যেষ্ঠপুত্র। ১৯৪৫ সালে তালেবপুর হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশের পর তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হয়ে ১৯৫১ সালে অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। এরপরে তিনি একই বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। ভালো ছাত্রের পাশাপাশি তিনি স্বভাব-চরিত্র ও ব্যবহারে ছিলেন অমায়িক। ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিন আবুল বরকত মেডিকেল কলেজের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় দাড়িয়ে বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন।এ সময় মিছিলে ছোড়া পুলিশের একটি গুলি তার গায়ে এসে লাগে ও তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কয়েকজন ছাত্র গুরুতর আহত আবুল বরকতকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে তিনি মারা যান। সেদিনই গভীর রাতে পুলিশের কড়া প্রহরায় শহীদ বরকতের লাশ আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়। পরে বরকতের পারিবারিক খরচে তার কবর পাকা করা হয়।
শহীদ আব্দুল জব্বার
শহীদ আব্দুল জব্বার ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহন করেন। গ্রাম- পাঁচুয়া, থানা- গফরগাঁও, জেলা- ময়মনসিংহ। তার পিতার নাম- মোঃ হাসেম আলী শেখ, মাতার নাম- সাফিয়া খাতুন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করার পরে পারিবারিক কারনে লেখাপড়া ত্যাগ করে পিতার কৃষিকাজে সাহায্য করা শুরু করেন। ১৫/১৬ বছর বয়সে তিনি খেয়ালের বশবর্তী হয়ে সকলের অজান্তে একদিন গৃহত্যাগ করে ট্রেনে চেড়পে নারায়নগঞ্জ আসেন। সেখানে জাহাজ ঘাটে এক ইংরেজ সাহেবের সান্নিধ্য লাভ করেন। সাহেবের অনুগ্রহে একটি চাকরি লাভ করে বার্মায় গমন করেন। ১০/১২ বছর বার্মায় থাকার পরে তিনি দেশে চলে আসেন। দেশে এসে নিজ গ্রামে তিনি দৈনন্দিন জিনিসপত্রের ছোটখাট একটি দোকান দেন। এরপর তিনি আমেনা খাতুন নামে এক মেয়েকে বিবাহ করেন ও এক পুত্র সন্তানের পিতা হন। সন্তানের নাম রাখেন নুরুল ইসলাম বাদল। ২১শে ফেব্রুয়ারীর একদিন আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত শাশুড়ীকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকা নিয়ে আসেন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে ছাত্র-জনতার মিছিলে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন ও স্লোগান দেন। মিছিলে পুলিশের অতর্কিত গুলীবর্ষনে তিনিও আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সারাদিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে রাতে তিনি মারা যান। তাকে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়।
শহীদ শফিউর রহমান
শহীদ শফিউর রহমান অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের হুগলী জেলার কোন্নগর গ্রামে ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারী জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম মৌলবী মাহবুবুর রহমান। তিনি কলকাতা গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আই কম পাশ করেন। পারিবারিক কারণে আর লেখাপড়া করতে পারেন নি। পরে ঢাকায় তিনি হাইকোর্টে করনিক পদে চাকুরী নেন। ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী শফিউর রহমান সকাল ১০টায় বাইসাইকেলে চড়ে ঢাকার ৬ নং রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ঐ দিন সকাল ১০টার কিছু পরে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নওয়াবপুর রোডে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ প্রদর্শন চলছিল। পুলিশ ঐ বিক্ষোভে গুলী চালালে একটি গুলী শফিউর রহমানের পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে বের হয়ে যায় ও তিনি তাৎক্ষনিকভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয় এবং সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি হাসপাতালেই মারা যান। মরহুম শফিউর রহমানের লাশ আত্মীয়-স্বজনদের কাছে হস্তান্তর না করে তার ৩টায় পুলিশের তত্বাবধানে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়। শফিউর রহমানের মৃত্যুর ৩ মাস পরে তিনি একটি পুত্র সন্তানের বাবা হন।
শহীদ অহিউল্লাহ
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের তালিকায় একজন নয় বছরের নাবালক ছেলে রয়েছে, যার নাম হলো অহিউল্লাহ। তিনি ছিলেন জনাব হাবিবুর রহমানের ছেলে। হাবিবুর রহমান পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী ছিলেন। ২২শে ফেব্রুয়ারী নবাবপুর রোডে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ গুলীবর্ষন করে। নবাবপুর রোডের খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাড়ানো অহিউল্লাহর মাথায় সরাসরি গুলী আঘাত হানে। এতে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। ২৩শে ফেব্রুয়ারীর ১৯৫২ তারিখের দৈনিক আজাদে অহিউল্লাহর শহীদ হওয়ার খবর ছাপানো হয়। পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলায় তার কবরের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।