১৯০৫ সালের বংগভংগ ও আজকের বাংলাদেশ

আমাদের ইতিহাসটা এখনও ভাল করে জানেনা আমাদের নতুন প্রজন্ম, আমাদের  অনুজ ও সন্তানেরা। এটা যে কোন জাতির জন্যে সত্যিই বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়। আমাদের জাতির সব কিছুই

দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ছে। আমরা বাংগালী না বাংলাদেশী তা আজও সুস্পস্ট নয়। আমাদের জাতিসত্বা আজও সুস্পস্ট ভাবে নির্ধারিত হয়নি। বিষয়টি খুবই সহজ, কিন্তু এক শ্রেণীর রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও এনজিও নেতা আমাদের জাতিসত্ত্বা বিষয়টা বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকিয়ে রাখার ব্যাপারে সদা সচেস্ট। এরা বিদেশীদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরা আমাদের স্বাধীনতার মূল ইরিহাসকে বিকৃত করার কাজে লিপ্ত। বংভংগের ইতিহাস নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে হাল সময়ের কথা গুলো বলে নিলাম। ১৯০৫ সালে নিখিল বংগ বা অখন্ড বংগদেশ রাজ্য বা প্রদেশ থেকে আলাদা করে  পূর্ববংগ ও আসামকে নিয়ে একটি প্রদেশ গঠণ করা হয়। ইংরেজরা এ কাজটা করেছেন নিজেদের প্রশাসনিক স্বার্থে। পূর্ব বংগ বা পূর্ব বাংলার নিপীড়িত জন সাধারন ইংরেজদের এই উদ্যোগকে সমর্থন করে। আসাম পূর্ববংগের প্রদেশের রাজধানী স্থাপিত হয় ঢাকায়। উল্লেখ্য যে, ১৬০৮ বা ১০ সালে অখন্ড বংগদেশের রাজধানী স্থাপিত হয় ঢাকায়। জনপদ হিসাবে ঢাকা একটি বেশ প্রাচীন এলাকা। এখানে ঢাকেশ্বরী মন্দির স্থাপিত হয়  পাশেই বুড়িগংগা নদী থাকার ফলে ঢাকা বন্দর হিসাবে গড়ে উঠে। নারিন্দার বিনতে বিবির মসজিদ স্থাপিত হয় ১৪৫৭ সালে। মীরপুরে শাহ আলী বোগদাদীর মাজার প্রতিস্ঠিত হয় ১৪৮০ সালে। প্রসংগ কারণেই ঢাকার পুরাণো কথা কিছু বললাম। অনেক গবেষক বলেন, ১৭১২ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ স্থানান্তরিত না হলে  ১৭৫৭ সালে পলাশীর মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতোনা।

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বলতে পূর্ববংগকেই বুঝানো হতো। দিল্লী সরকার পূর্ববংগ থেকেই সবচেয়ে বেশী খাজনা আদায় করতো। কোলকাতা শহর এবং পরে মহানগর হিসাবে গড়ে উঠেছে  পূর্ববংগকে শোষণ করে। কোলকাতার শিল্প কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ করতে পূর্ববংগ। জব চার্ণক সুতানুটি গোবিন্দপুর ও কলিকাতা এই তিনটি গ্রাম নিয়ে বাজারের পত্তন করেন ১৬০৮ সালে। যখন ঢাকা একটি পূর্ণংগ রাজধানী। তারও আগে ১৫৯০ বা ৯৫ সালে মোগল সেনাপতি মান সিংহ ঢাকায়  সেনা ছাউনী স্থাপন করেন। মগ হামলাকে প্রতিহত করার জন্যেই ওই ছাউনী স্থাপন করা হয়েছিল। ১৯০৬ সালে ঢাকাতেই মুসলীম লীগ গঠিত হয়। সারা ভারতের মুসলীম নেতারা ঢাকায় এসেছিলেন নবাব সলিমুল্লাহর আহবানে। পাকিস্তান প্রতিস্ঠার সময়ে বলা হয়েছিল পূর্ববংগ বা পূর্ববাংলাকে আলাদা স্বাধীন দেশ করা অপরিহার্য, কারণ , এই অঞ্চলটি  ইংরেজ এবং তাদের দোসর হিন্দু জমিদার ও আমলা দ্বারা সবচেয়ে বেশী শেষিত হয়েছে। ১৭৯৩ সালে সূর্যাস্ত আইন সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে পূর্ববংগের জনসাধারনকে।

এ কারণেই ১৯০৫ সালে নতুন প্রদেশ পূর্ববংগ ও আসাম গঠণের সময় সবচেয়ে বিরোধিতা করেছেন নিখিল বংগের নামজাদা  হিন্দু জমিদার , বুদ্ধিজীবী ও এলিটশ্রেণী। প্রসংগত: ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু কথা উল্লেখ না করলে মনে হয় লেখাটি অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেছিল এ দেশের মুসলমান সমাজ। বিশেষ করে আলেম সমাজ। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত দীর্ঘ একশ’ বছর মুসলমানরা একাই এই স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে গেছে। ১৮৮৫ সালে ইংরেজের নেতৃত্বে ভারতীয় কংগ্রেস প্রতিস্ঠিত হয়। এটা ছিল ইংরেজদের সাথে কথা বলার জন্যে একটি সমিতি। হিন্দুরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেয় ১৯০০ সালের পর। এর আগ পর্যন্ত হিন্দুরা ছিল ইংরেজ শোষণের সহযোগী ও বন্ধু। ১৯০৫ সালে আলাদা পূর্ববংগ  আসাম প্রদেশ গঠণের বিরোধিতা করেছে তাদের শোষণকে অব্যাহত রাখার জন্যে। অতীব বেদনার বিষয় হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার নতুন পূর্ব বংগ প্রদেশ গঠণের বিরোধিতা করেছেন তাঁদের জমিদারী ও ব্যবসার স্বার্থে। আগেই বলেছি ইংরেজরা নতুন প্রদেশ গঠন করতে চেয়েছিল নিজেদের প্রশাসনিক স্বার্থে। কিন্তু হিন্দুরা যখন এর বিরোধিতা করলো, এমন কি সন্ত্রাসী আন্দোলন শুরু করলো তখন ১৯১১ সালে নতুন প্রদেশ গঠন বাতিল করে দিলো। সোজা ভাষায় বলতে গেলে  হিন্দু নেতা, জমিদার, বড় বড় ব্যবসায়ীরা সব সময় চেয়েছে পূর্ববংগের মুসলমানদের শোষন করতে। এটাই ছিল তাঁদের রুটি রোজগারের পথ। তাঁরা মনে করতো পূর্ববংগ আলাদা প্রদেশ হয়ে গেলে মুসলমান কৃষকদের আর শোষণ করা যাবেনা। এমন কি ১৯১২ সালে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব উঠলে কবিগুরু সহ কোলকাতার নামী দামী সব হিন্দু নেতারা এর বিরোধিতা করেছেন। কোথাও কোথাও কবিগুরু এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কবিগুরুর জমিদারীর বৃহত্‍ অংশ ছিল পূর্ববংগে। তিনি ভেবেছিলেন প্রজারা শিক্ষিত হয়ে গেলে আর শোষন করা যাবেনা। সেই কবিগুরু আজ  স্বাধীন বাংলাদেশে দেবতার মতো পূজনীয়। তাঁর লেখা গাণ আজ আমাদের জাতীয় সংগীত। তাঁর লেখা গাণ ভারতেরও জাতীয় সংগীত। আসলে আমাদের জাতীয় সংগীত নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো ৭১ সালে কোলকাতায় ভারত সরকারের নির্দেশেই। কবিগুরুকে নিয়ে আমাদের দেশে সরকারী ভাবে সপ্তাহব্যাপী উত্‍সব পালিত হয়। উত্‍সব পালনের জন্যে দেশী বিদেশী কোম্পানীর টাকার অভাব হয়না। উত্‍সব পালনের জন্যে উদ্যোক্তারও অভাব হয়না। অপরদিকে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালনের জন্যে সরকারী বেসরকারী কোন মহল থেকেই প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যায়না। এসব হচ্ছে জাতি হিসাবে আমাদের হীনমন্যতা।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় মুসলমানেরা অখন্ড বাংলাদেশ চেয়েছিল। কিন্তু রহস্যের বিষয় হলো কংগ্রেস ও হিন্দু কমিউনিস্ট নেতারা মুসলীম মেজরিটি বা সংখ্যাগরিস্ঠ স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি। ১৯০৫ সালে ওইসব নেতারা বংগদেশের অখন্ডতা রক্ষা করার জন্যে রক্ত দিতে রাজী ছিলেন। ৪৭ সালে তাঁরা কেন বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করতে রাজী হলেন তা আমাদের নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই জানতে হবে। আবার ৭১ সালে সেই হিন্দু ভারত বা পশ্চিম বংগ কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেছে তাও জানতে হবে। অখন্ড বংগদেশে মুসলমানেরা ছিল মেজরিটি বা সংগরিস্ঠ। তাই সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতারা মনে করেছেন সংগরিস্ঠ গণতান্ত্রিক অখন্ড বাংগদেশে হিন্দুদের মাইনরিটি হিসাবে বাস করতে হবে। তাই তাঁরা বাংগালী মুসলমানদের  সাথে না থেকে দিল্লীর অধীনে অবাংগালী হিন্দুদের অধীনে থাকাটাকে মংগলময় মনে করেছে। অখন্ড ভারতে মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে রাজী ছিল। কিন্তু হিন্দু নেতারা মুসলমানদের দাবী মানতে রাজী নয়। এখন ভারতীয় লেখক এবং রাজনীতিকরা স্বীকার করছেন যে, ভারত বিভক্ত হয়েছে  হিন্দু নেতাদের গোঁড়ামী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে। ৭১ বাংগালী মুসলমানরা স্বাধীনতা চেয়েছে পাকিস্তানীদের অত্যাচার ও শোষণের কারণে। ৭১ সালে বাংগালীরা পাকিস্তানী মুসলমানদের সাথে একসাথে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল সাম্প্রদায়িক হিন্দু শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্যে। ১৯০৫, ৪৭ ও ৭১ সাল একই সূত্রে গাঁথা। আজ হোক আর কাল হোক পূর্ববংগের বাংগালী মুসলমানরা স্বাধীন হতোই। তাঁরা অবাংগালী হিন্দু বা মুসলমান কোন শোষণই মেনে নিতোনা। যেমন ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাংগালী মুসলমানরাই প্রথম বিদ্রোহ করেছে।

লেখক: Ershad Mazumder
কবি ও সাংবাদিক

ershadmz40@yahoo.com